দখল-দূষণ থেকে নদী বাঁচানো যাচ্ছে না কেন?

বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ১৭:২৪

নদীগুলো বেশি দখল-দূষণের শিকার
দখল ও দূষণের হাত থেকে নদ-নদী, খাল-বিল বা জলাশয় রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানান পদক্ষেপের কথা আলোচনায় এসেছে। নদীর অবৈধ দখল চিহ্নিত করার পর উচ্ছেদের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে বছরব্যাপী ক্রাশ প্রোগ্রাম হয়েছে। নদী থেকে সকল দখলদার-মাছপ্রকল্প-সুইসগেট-বাঁধ-স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেতু অপসারণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
কার্যত নদী দখল যতটা হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে তার চেয়ে কম। নদীর যেসব জমি ইজারা দেয়া হয়েছে তা-ও বাতিল হয়নি। নদী রক্ষা কমিশন বলছে, অবৈধ উচ্ছেদসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গড়িমসি ও দায়িত্বহীনতার কারণে উচ্ছেদ অভিযান জোরদার হয়নি।
নদী বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপল পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশ দিয়ে বহমান নদীগুলো বেশি দখল-দূষণের শিকার। এগুলোতে শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য বেশি ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গা বর্জ্য ফেলার ভাগাড় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অন্তত সাত-আট দশক ধরে। দুই তীরে গড়ে ওঠা সব কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গার দূষণ এখন আর এ নদীতে সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদপুর অঞ্চলের পদ্মা-মেঘনার মোহনায়ও। আড়িয়াল খাঁ, গোমতী, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে অনুভূত হচ্ছে দূষণ। নদীর পাশাপাশি এখন দেশের বড় বড় বিলগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে।
দখল উচ্ছেদ বা দূষণবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হয় মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীকে কেন্দ্র করে। এর বাইরের দখল হওয়া নদ-নদী প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের বাইরে থেকে যায়। বাস্তবতা হল, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ অশুভ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। নদী দখলে প্রথমে নদীর তীরবর্তী এলাকায় বালু ও মাটি ফেলে ভরাট করা হয়। এরপর নদীকে সংক্ষিপ্ত করে নির্মাণ করা হয় স্থাপনা। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সারা দেশের নদী, খাল ও জলাশয় দখল হয়ে যাচ্ছে।
রিভারাইন পিপল তাদের সমীক্ষায় যেসব নদীকে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি দখল-দূষণের শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এর মধ্যে রয়েছে- রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদী; কুমিল্লা অঞ্চলের ডাকাতিয়া; চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী, হালদা; নেত্রকোনার মগড়া; খুলনার ময়ূর; হবিগঞ্জের খোয়াই ও সোনাই; সিলেট অঞ্চলের সুরমা, পিয়াইন, বিবিয়ানা, বাসিয়া; চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ অঞ্চলের নবগঙ্গা; টাঙ্গাইলের লৌহজং, লাঙ্গুলিয়া; ঢাকা অঞ্চলের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বংশী; কক্সবাজারের বাকখালী; ময়মনসিংহ অঞ্চলের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র; রংপুরের ঘাঘট, ইছামতী; দিনাজপুরের পুনর্ভবা; বগুড়ার করতোয়া; নওগাঁ-জয়পুরহাটের ছোট যমুনা; নাটোরের নারোদ; কুড়িগ্রামের সোনাভরি; বরিশাল অঞ্চলের সন্ধ্যা; ফরিদপুরের কুমার; সাতক্ষীরার আদি যমুনা; যশোরের কপোতাক্ষ ও ভৈরব; নরসিংদী অঞ্চলের হাড়িধোয়া; গাজীপুরের চিলাই।
জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের দেশে কলকারখানাগুলোই নদী দূষণের প্রধান উৎস। ২০০৮ সনের এক সরকারী গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়। এসব থেকে নানারকম দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ত তরল দূষক পরিবেশের সীমাহীন ক্ষতি সাধন করে চলছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত ৯টি দীর্ঘস্থায়ী জৈব দূষক এলড্রিন, ক্লোরডেন, ডিডিটি, ডাইএলড্রিন, এনড্রিন, হেপ্টক্লোর, হেক্সাক্লোর বেনজিন, মিরেক্স ও টক্সাফেন। এগুলো ১৯৯৮ সনে সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ হলেও এর ৭টি বাংলাদেশে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
নদ-নদী ও জলাধারগুলোর মিঠা পানি হলো দেশের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ দেশের জনপ্রশাসনে এ বিষয়ে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ২০১৯ সালে যখন প্রথমবারের মতো নদ-নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়, তখন সারা দেশে দখলদারের সংখ্যা ছিলো ৫৭ হাজার ৩৯০। উচ্ছেদ হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৯টি দখল। একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নতুন দখলদারের সংখ্যা পাঁচ হাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সারা দেশে ৬৩ হাজার ২৪৯। পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা না থাকার কারণে জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারেনি বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকদের ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের সুপ্রিমকোর্ট বহুকাল আগেই তাদের নদী দখলকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট নদী দখলকারী মন্ত্রীদের জরিমানার ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশেও নদী দখল ও দূষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দেশে নদী রক্ষায় আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ দৃশ্যমান নয়। ফৌজদারি আইনে নদী দখলের যে সাজার কথা বলা আছে, আইন করে তার মাত্রা আরো বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতান কামাল বলেন, নদী রক্ষায় আইন প্রয়োগ সমভাবে হয় না, সুষ্ঠুভাবে হয় না। যেখানে ক্ষমতা যুক্ত সেখানে প্রয়োগ হয় না। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নদী মানুষের। জনগণ এর মালিক। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাকে যদি আমরা বাঁচাতে না পারি, তাহলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। কাজেই নদী রক্ষায় আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘ পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭ ও হাইকোর্টের সকল রায় মেনে, সকল নদীর সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। তারা বলেছেন, নদী রক্ষা না হলে দেশ রক্ষা হবে না। প্রধানমন্ত্রী নদী রক্ষায় তার প্রত্যয়ের কথা বার বার প্রকাশ করেছেন। নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা আন্তরিক থেকেও নির্বাহী ক্ষমতার অভাবে খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না। এখন প্রয়োজন নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন একটি শক্তিশালী নদী কমিশন। উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে ঘোষণা করেছেন, অতএব এই সত্ত্বার ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।